![]() |
ভাত মহাশ্বেতা দেবী |
হ্যালো বন্ধুরা আশা করি তোমরা প্রত্যেকে ভালো আছো। আমাদের Digital Porasona-র Online Platform-এ তোমাদের স্বাগত। আমাদের Website -এর পক্ষ থেকে আজকের বিশেষ নিবেদন দ্বাদশ শ্রেণীর বাংলা গল্প মহাশ্বেতা দেবী রচিত "ভাত"। তবে চলো শিক্ষার্থী বন্ধুরা গল্পটির চরিত্র, লেখিকা পরিচিতি, বিষয়বস্তু, নামকরণ এর বিস্তারিত বিবরন জেনে নিই...
ভাত
মহাশ্বেতা দেবী
ভাত গল্পের চরিত্রঃ
১। উৎসব নাইয়া ( উচ্ছব ) । গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র। গল্পটি তাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত- বিবর্তিত হয়েছে। উৎসবের পিতার নাম হরিচরণ নাইয়া। আলোচ্য গল্পে উৎসব তার ঠাকুমা-র প্রসঙ্গ ও এনেছে।
২। উৎসবের স্ত্রী।
৩। উৎসবের মেয়ে ( চন্নুনি ) ।
৪। ছোটো খোকা (উৎসবের ছেলে )।
৫। বাসিনী। ( গ্রাম সম্পর্কে উৎসবের বোন )। এই বাসিনীই উৎসবকে কলকাতায় তার মনিবের বাড়িতে নিয়ে আসে। যেটাকে বড়ো বাড়ি বলা হয়েছে।
৬। বড়ো কর্তা ( বড়ো বাড়ির প্রধান )।
৭। বড়ো বাড়ির বড়ো বউ।
৮। বড়ো বাড়ির মেজো বউ।
৯। বড়ো পিসিমা ( বড়ো বউ এর পিসি শাশুড়ি )।
১০। বামুন ঠাকুর। ( বড়ো বাড়ির রান্নার ঠাকুর )।
১১। তান্ত্রিক।
১২।নার্স। ( বড়ো কর্তার সেবিকা )।
১৩। মহানাম শতপথি। (পুরোহিত )। উৎসবের গ্রামের শ্রাদ্ধের ব্রাম্ভন।
১৪।সাধন।
১৫।সতীশ মিস্ত্রি । ( সতীশ বাবু )।
১৬। বড়ো বাড়ির খাস ঝি। মুটকি প্রকৃতির দেখতে।
১৭। শিব মন্দিরের চাতালে বসা তিনটি ছেলে। ( যারা তাস খেলছিল )।
১৮। পেশাদারি দক্ষ শব-বাহকগণ।
১৯। কীর্তন দল।
২০।পুলিশ দল।
ভাত গল্পের লেখিকা মহাশ্বেতা দেবীর পরিচিতিঃ
মহাশ্বেতা দেবী জন্মগ্রহন করেন ১৪ জানুয়ারি ১৯২৬ সালে। তাঁর স্বামীর নাম বিজন ভট্টাচার্য। তাঁর পুত্রের নাম নবারুন ভট্টাচার্য। তিনি ছিলেন একজন ভারতীয় বাঙালি কথাসাহিত্যিক ও মানবতাবাদী লেখিকা। তার উল্লেখযোগ্য রচনাগুলি হল হাজার চুরাশির মা, রুদালি, অরণ্যের অধিকার, তিতুমির ইত্যাদি।তিনি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, মধ্যপ্রদেশ প্রভৃতি আদিবাসী উপজাতিগুলির অধিকার ও ক্ষমতায়নের জন্য কাজ করেছিলেন। তিনি সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার, জ্ঞানপীঠ পুরস্কার ও র্যামন ম্যাগসেসাই পুরস্কার সহ একাধিক সাহিত্য পুরস্কার এবং পদ্মশ্রী ও পদ্মবিভূষণ লাভ করেন। পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাকে বঙ্গবিভূষণে ভূষিত করেছিল। তিনি পরলোক গমন করেন ২৮ জুলাই ২০১৬ সালে।
ভাত গল্পের উৎসঃ
মহাশ্বেতা দেবীর 'শ্রেষ্ঠ গল্প' সংকলন থেকে 'ভাত' গল্পটি নেওয়া হয়েছে। আলোচ্য গল্পটি ১৯৮২ সালে 'ম্যানিফেস্টো' পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়।
ভাত গল্পের বিষয়বস্তুঃ
গ্রামের এক সর্বহারা নিরন্ন মানুষের গল্প ‘ভাত’, লেখিকা— মহাশ্বেতা দেবী। গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র উৎসব নাইয়া। সবাই তাকে ডাকে উচ্ছব বলে। মাতলা নদীর বিধ্বংসী জলের তোড়ে সে তার স্ত্রী, পুত্রকন্যা সব হারিয়েছে। নষ্ট হয়েছে মাথা গোঁজার আশ্রয়টুকুও। দু-মুঠো ভাতের আশায় গ্রামের মেয়ে বাসিনীর মনিববাবুর বাড়িতে ফাইফরমাশ খাটার জন্যে কলকাতায় এসেছে উচ্ছব। সেখানে নাকি ভাতের ছড়াছড়ি। বাদা থেকে আসে চাল। উচ্ছব অবাক হয়। এদিকে মনিববাবুর অন্তিম দশা। তা থেকে মুক্তিলাভের জন্য তান্ত্রিকের শরণাপন্ন সবাই। উচ্ছব এই পরিস্থিতিতেই সেই বাড়িতে হাজির হয়। অভুক্ত অবস্থায় সারাদিন কাঠ কাটে সে। অথচ ভাত জোটে না। সকলেই ‘কত্তাবাবু’কে নিয়ে নানাভাবে ব্যস্ত। দিনের শেষে সে ক্লান্ত শরীরে মন্দিরের চাতালে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। তার ঘুম ভাঙে কারও ধাক্কায়, শোনে কত্তাবাবু গত হয়েছেন—বাড়ির সব খাবার ওরা ফেলে দিচ্ছে। উচ্ছব ভাতের হাঁড়িটি নিজের জিম্মায় নেয়, ছুটে যায় স্টেশনে, সেখানে বসে পাগলের মতন দু-হাতে ভাত খেতে থাকে, মনে মনে ভাত খাইয়েও দেয় তার হারানো স্ত্রী, পুত্রকন্যাদের। তারপর হাঁড়ির কানায় মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ে উচ্ছব। পরদিন সকালে হাঁড়ি চুরির অপরাধে তাকে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়।
একজন সর্বহারা মানুষের আখ্যান ‘ভাত’। যার জীবনের সব সুখ, সব আনন্দ চিরতরে হারিয়ে গেছে মাতলা নদীর বন্যায়। সে দু-মুঠো ভাতকে আঁকড়ে ধরেই জীবনের সংগ্রামে টিকে থাকতে চায়। সেই ভাতের জন্যই গল্পের শেষে সে শাস্তি পায়। এই হৃদয়বিদারক কাহিনিটিকেই ‘ভাত’ গল্পে উপস্থাপিত করেছেন মহাশ্বেতা দেবী। সঙ্গে রয়েছে সামাজিক কুসংস্কার, বিলাসব্যাসন, গরিব মানুষের প্রতি উচ্চবিত্তের উদাসীনতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও তার ভয়াল রূপ, পরিবারের বন্ধন, প্রেম, সব হারানোর হাহাকার—সবকিছুই উচ্ছব চরিত্রের মাধ্যমে গল্পকার প্রকাশ করেছেন। সব মিলিয়ে গল্পটি প্রকৃতির রোষে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া বাংলার এক প্রান্তিক মানুষের হাহাকার, যা আবহমান বাংলার এক স্বাভাবিক চিত্র।
ভাত গল্পের নামকরনঃ
মহাশ্বেতা দেবীর ‘ভাত’ গল্পটির কেন্দ্রীয় চরিত্র উৎসব, লোক যাকে ডাকে ‘উচ্ছব’ বলে—পুরো নাম উৎসব নাইয়া। গল্পে তার চেহারার বর্ণনা—'বুনো বুনো'। চাহনি উগ্র, পরনে খাটো ময়লা লুঙ্গি। মাতলার বন্যার তোড়ে সে তার পরিবার, সন্তান সমস্ত হারিয়েছে চিরতরে। আজ তার আপন কেউ নেই, কিছু নেই। গ্রাম সম্পর্কিত বোন বাসিনীর ‘কত্তাবাবু’ অর্থাৎ মনিবের বাড়িতে, কলকাতায়, সে এসেছে দু-দিন ফেলেছেড়ে ভাত খেতে। এদিকে ‘কত্তাবাবু’র বাড়িতে তখন হোম-যজ্ঞ হচ্ছে। কারণ তিনি মৃতপ্রায়। রোগটা মারাত্মক, তার থেকে নিষ্কৃতির জন্যই এই আয়োজন। উচ্ছব এখানে এসেও অসহায়। সে ভেবে পায় না কী করবে। কাজ আছে অবশ্য এ বাড়িতে। আর ভাতেরও অভাব নেই। বাদা থেকে চাল আসছে নিয়মিত। তান্ত্রিক এসেছেন। উপচার, আয়োজন সম্পূর্ণ। শুধু কাঠ কাটা বাকি। উচ্ছব খায়নি অনেকদিন। অভুক্ত উচ্ছব কাঠ কেটে দেবে। বিনিময়ে জুটবে খাবার। বাবুর এই বাড়িতে চালের ছড়াছড়ি। ঝিঙেশাল, রামশাল, কনকপানি, পদ্মজালি আরও কত কী! এমনকি, ঝি-চাকরদের জন্যও রয়েছে মোটা সাপ্টা চাল। উচ্ছব দেখে আর তার চোখ যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসে। বাসিনীকে প্রশ্ন করে সে, শোনে বাদায় হয় এসব চাল ৷ বাড়ির এক-একজন ব্যক্তি এক-এক রকমের চালের ভাত খায় ! উচ্ছব আর পারে না। একটু শুকনো চালই চায় বাসিনীর কাছে—মুখে দেবে। বাসিনী তা দিতে অপারগ, সে চলে যায়। হাহাকার করে উচ্ছব, মনে পড়ে যায় চন্নুনীর মায়ের কথা, চন্নুনীর কথা। সে এক সুন্দর স্বপ্ন ছিল। মাতলার জলের দাপট তার সংসার ধ্বংস করে দিয়ে গেছে—সে আজ একা, বাসিনীর মনিববাবুর বাড়ির কৃপাপ্রার্থী। ক্ষণে ক্ষণে তার মন স্মৃতির সরণি বেয়ে পাড়ি দেয় সেই দিনটাতে। স্পষ্ট শোনে চন্নুনীর মায়ের গলা। সব হারানোর সেই ভয়ংকর মুহূর্ত। সে অনুভব করে এ কথা, “চন্নুনীদের যদি রেখে যেত ভগবান, তাহলে উচ্ছবের বুকে শত হাতির বল থাকত আজ।” কিন্তু চমক ভাঙে বড়ো পিসিমার কথায়। তিনি তাড়া দিতে থাকেন, কাঠ কাটতে হবে। এদিকে উচ্ছবের পেটে তখন বড়ো খিদে। একফাঁকে বাসিনী এসে এক ঠোঙা ছাতু দিয়ে যায় তাকে, খেয়ে নিতে বলে। ওদিকে পুরোদমে চলতে থাকে ‘বুড়ো কত্তাবাবু’র কল্যাণ কামনায় হোম-যজ্ঞ। উচ্ছব কাজ করে আর চোখে তার ভাতের স্বপ্ন। ভাত পাবে সে। ভাত খাবে। গ্রামের সতীশবাবু মনে করে উৎসবের বুদ্ধি লোপ পেয়েছে। সব হারিয়েও সে ভাত ভাত করছে। তবে সতীশবাবুর এটা বোঝার কথা নয়। কারণ, তাঁর সব আছে। কিন্তু সব হারিয়ে উৎসব যে ‘প্রেত’ হয়ে গেছে। ভাতের লোভে একসাথে আড়াই মন কাঠ কাটল সে। নইলে তার শরীরে ক্ষমতা ছিল না। কিন্তু এরপরও সে ভাত পেল না, কারণ, সকলেই তখন ব্যস্ত তান্ত্রিকের অনুষ্ঠানে। উচ্ছব গিয়ে বসে শিবমন্দিরের চাতালে, শুয়ে পড়ে, শুয়ে শুয়ে কাঁদে। এরপর সে ঘুমিয়ে পড়ে খিদে আর ক্লান্তিতে। তার ঘুম ভাঙে সাঁঝের বেলা। চারদিকে তখন বেশ ভিড়। কারণ, ‘কত্তাবাবু’ গত হয়েছেন। সকলে বিলাপ করছে। বাড়িময় ব্যস্ততা। বড়ো পিসিমা বাসিনীকে বলেন, “সব্বস্ব রান্না পথে ঢেলে দিগে যা।” উচ্ছব চমকে ওঠে। সে বোঝে সব ভাত এরা ফেলে দিতে যাচ্ছে। উচ্ছবের মাথায় বুদ্ধি খেলে যায়। সে বড়ো ডেকচিটা নিয়ে নেয় নিজের জিম্মায়। বলে “দূরে ফেলে দে আসি।” এরপর সে দৌড়োতে থাকে। তার চেহারায় তখন বন্য হিংস্রতা। ভাত সে খাবেই। ছুটে চলে যায় সে স্টেশনে। খাবলে খাবলে ভাত খায় হাঁড়ি থেকে। মুখ ডুবিয়ে খায়। ভাবে বাদার কথা। তার আত্মার আত্মীয় চন্নুনীর মা, চন্নুনী, ছোটোখোকা সবাইকে মনেমনে ভাত খাওয়ায় সে। জল খায়, তারপর হাঁড়ির কানায় মাথা ছুঁইয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। পরদিন পেতলের ডেকচি চুরির অপরাধে সকলে তাকে ধরে মারতে মারতে থানায় নিয়ে যায়। আসল বাদাটা তার কাছে থেকে যায় অধরা।
গল্পটি লেখিকা শেষ করেছেন এভাবেই, ভাতের স্বপ্ন নিয়ে। ভাতের স্মৃতি হাতড়ে এবং খাবার আশায় গল্পের মুখ্য চরিত্র উচ্ছবের দিন কেটেছে। সেই ভাতের কারণেই সে গল্পের শেষে অপরাধী হয়ে যায়। ভাতকে কেন্দ্র করেই গল্পের কাহিনি আবর্তিত হয়েছে। তাই সমস্ত দিক থেকেই গল্পটির ‘ভাত’ নামকরণ সম্পূর্ণ প্রাসঙ্গিক।
সুপ্রিয় শিক্ষার্থী বন্ধুরা আজ এই পর্যন্ত। আগামী পোষ্টে আমরা ভাত গল্পটির সংক্ষিপ্ত ও অতি-সংক্ষিপ্ত এবং একটি বাক্যে উত্তর দাও প্রশ্নোত্তর নিয়ে হাজির হবো। ততক্ষণে ভালো থেকো, সুস্থ থাকো। তোমাদের কোনো জিজ্ঞাসা থাকলে ইনবক্স করতে পারো। ধন্যবাদ...