করোনা ভাইরাস রচনা |
করোনা ভাইরাস রচনা,
WBCHSE Bengali Rachana
WBBSE Bengali Rochona Covid-19
Corona Viras Bengali Paragraph/ Rochona,
করোনা ভাইরাস
ভূমিকাঃ সৃষ্টির ঊষাকাল থেকে মানুষ নিজের প্রচেষ্টা ও বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে সভ্যতাকে উন্নতির চুড়ায় পৌঁছে দিয়েছে । বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বলে বলীয়ান হয়ে জল ,স্থল ও অন্তরীক্ষে তার আধিপত্য বজায় রেখেছে। মানুষ যত তার সীমা বৃদ্ধি করেছে ততই নতুন বাধার সম্মুখীন হয়েছে। পৃথিবীকে নিজ মুষ্টিতে করায়ত্ত করতে গিয়ে সৃষ্টির উগ্র রূপও দর্শন করতে হয়েছে মানব সভ্যতাকে । কখনো খরা,বন্যা, ভুমিকম্প কখনো বা মহামারীর করাল থাবা উলট পালট করেছে সুন্দর সৃষ্টিকে। সাম্প্রতিক এমনই এক মহামারী যা একবিংশ শতাব্দীকে তিন বছরের জন্য স্তব্ধ করে দিয়েছে সমগ্র দিক থেকে । সেই অতিমারি মহামারীর নাম করোনা ভাইরাস।
মহামারী কি? মানুষ তথা বিভিন্ন প্রাণী বা উদ্ভিদের মধ্যে রোগ-জরা লেগেই আছে । এমন কিছু রোগ দেখা দিয়েছে যার কারনে গ্রামের পর গ্রাম, শহর ,নগর উজাড় হয়ে গেছে । তখন আমরা বলি মহামারী বা অতিমারী দেখা দিয়েছে। যখন কোনো রোগ স্বল্প সময়ের জন্য বিপুল সংখ্যক মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে, তখন তাকে মহামারী বলে ।আর কোনো রোগ যখন দেশ বা দেশের গণ্ডী অতিক্রম করে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে, তাকে বলে অতিমারী। ২০২০ সালে করোনা যখন চীনের সীমানা ছাড়িয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ল, তখন তা অতিমারীর আকার নিল। বর্তমানে করোনা অতিমারি রোগ।
মহামারীর ইতিহাসঃ বিশ্ব জুড়ে মহামারীর ইতিহাস বেদনাদায়ক। কখনো কলেরা,কখনো প্লেগ, কখনো ব বার্ড ফ্লু, সোয়াইন ফ্লু। আর বর্তমানে শীর্ষ তালিকায় সংযোজিত হয়েছে করোনা ভাইরাস। এই মহামারীর প্রকোপ প্রান কেড়েছে লক্ষ লক্ষ মানুষের।
করোনা ভাইরাসের উৎসঃ করোনা ভাইরাসের উৎস সম্পর্কে পৃথিবী জুড়ে রয়েছে বিতর্ক। কারো মতে ইহা কৃত্রিম উপায়ে গবেষণাগারে তৈরি, কেউ মনে করে এই ভাইরাসের উৎস হলো বাদুড়। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার বক্তব্য অনুসারে এই ভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হয় চীন দেশের হুনান প্রদেশের রাজধানী উহান শহর থেকে। সেখান থেকেই এই ভাইরাস মানুষ থেকে মানুষে ছড়িয়ে পড়ে আজ বিশ্ব মহামারী রুপ ধারণ করেছে।
নামকরণঃ প্রথমেই বলে রাখা দরকার যে করোনা এবং ভাইরাস দুটি শব্দই লাতিন ভাষা থেকে নেওয়া হয়েছে । করোনা শব্দের অর্থ মুকুট এবং ভাইরাস বলতে বোঝায় 'বিষ'। ভাইরাসটির নাম করোনা হওয়ার কারণ হল এর আকৃতি। ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ-এ দেখা গেছে এই ভাইরাসটি শরীরজুড়ে খাজকাটা অসংখ্য কাঁটার মতো, আপাতভাবে একটি রাজমুকুটের মতো । এই ভাইরাসটি অন্যান্য ভাইরাসের তুলনায় আয়তনে বেশ বড়।
করোনা'র চরিত্র বিশ্লেষণঃ
করোনা ভাইরাস দুনিয়ায় নতুন নয়। ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে প্রথম মানুষের শরীরে করোনা ভাইরাসের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এরপর থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত মানুষের শরীরে প্রায় পাঁচ প্রকারের করোনা ভাইরাস আবিষ্কৃত হয়। তবে আজকের করোনা ভাইরাস পুরনো করোনা ভাইরাস থেকেঅনেকাংশে ভিন্ন । যার ফলে প্রথম থেকে একে চিহ্নিত করা হচ্ছে নোভেল করোনা ভাইরাস নামে। ২০১৯ সালের শেষে চীনে এই ভাইরাসের সংক্রমণ দেখা যায়। মিউকাস এর মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে এই ভাইরাসট বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে আক্রমণ করে। এক্ষেত্রেও আঘাত করে মানুষের শ্বাসযন্ত্র। এই ভাইরাসটী ছোঁয়াচে প্রকৃতির । এই ভাইরাস রোগটিকে বিশেষজ্ঞরা চিহ্নিত করেছেন কোভিড-১৯ নামে। যার পুরো কথা হল Corona Virus Disease 19 বা COVID-19.
সংক্রমন
এই ভাইরাসটির সংক্রমন বিশেষজ্ঞদের মতে চারটি পর্যায়ে ঘটে । প্রথমটি হল, যারা বিশেষভাবে সংক্রমিত অঞ্চল থেকে সরাসরি সংক্রমিত হয়ে এসেছে। দ্বিতীয় পর্যায়টি হল, যেখানে সরাসরিভাবে সংক্রমিত হওয়া সেই সব মানুষ গুলি নিজেদের সংস্পর্শে আসা অন্যান্য মানুষদের শরীরে ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটায়। তৃতীয় পর্যায়ে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে এক বৃহত্তর অঞ্চল জুড়ে। এই পর্যায়ে সংক্রমিত ব্যক্তির সরাসরি সংস্পর্শে না আসা ব্যক্তিও তার পারিপার্শ্বিক পরিবেশ থেকে সংক্রমিত হয়। চতুর্থ পর্যায়ে সংক্রমণ রাজ্য কিংবা দেশজুড়ে এক মহামারীর আকার ধারণ করে। তখন ভ্যাকসিন ছাড়া তাকে রোধ করা প্রায় অসম্ভব।
চিকিৎসাঃ
করোনায় আক্রান্ত হওয়ার অন্যতম কারন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার অভাব। এই রোগের উপসর্গগুলি হল গলা ব্যথা, জ্বর, শ্বাসকষ্ট । এই রোগের নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই । এইজন্য ভাইরাসের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি গড়ে তোলা উচিত।
প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাঃ
এর নির্দিষ্ট চিকিৎসা না থাকায় উপসর্গ অনুযায়ী এর চিকিৎসা হয়ে থাকে। এর থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হল ভ্যাক্সিনেশন বা টিকাকরণ। বিশেষজ্ঞদের মতে এর প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা বলতে সামাজিক বা শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার প্রথাকে বোঝানো হয়। এই নিয়মের পালনের জন্যই বিভিন্ন দেশ জারি করে লকডাউন। তাছাড়া বিশেষ ধরনের মাস্কের ব্যবহার এবং হাত পরিষ্কার রাখার জন্য স্যানিটাইজার তথা সাবান ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন।
টিকাকরণঃ
দীর্ঘ গবেষণার পর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন আবিষ্কারে সক্ষম হয়েছে। সর্বপ্রথম যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি দল দীর্ঘ গবেষণার পর করোনা ভাইরাসের টিকা আবিষ্কার করে। এর পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র,রাশিয়া ও চীন নিজের দেশে ভ্যাকসিনের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ শুরু করে দেয়। রাশিয়াতে সর্বপ্রথম এই ভ্যাকসিন গ্রহণ করেন রাশিয়ার রাষ্ট্রপতির কন্যা। আমাদের দেশও ভ্যাকসিন আবিষ্কার এবং তার প্রয়োগ শুরু করে দিয়েছে। ভারতের দুটি সংস্থা: সিরাম ইনস্টিটিউট এবং ভারত বায়োটেক দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর দুটি ভ্যাকসিন নিয়ে আসে। একটির নাম হলো কোভিশিল্ড এবং অপরটি কোভ্যাক্সিন। প্রথমে পরীক্ষামুলকভাবে এর প্রয়োগ শুরু হয় এবং ট্রায়ালের পর্যায় সফলভাবে শেষ হবার পর ধাপে ধাপে ব্যাপকহারে জনমানসে টিকাকরণ শুরু হয় ।
করোনার প্রত্যক্ষ প্রভাবঃ
বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসের প্রত্যক্ষ প্রভাব সুদূরপ্রসারি। আমরা প্রতিদিন দেখতে পাচ্ছি চোখের সামনে প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ মানুষ করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে। ঘন জনবসতি অঞ্চলে আক্রান্তের হার বেশি। এই আক্রান্ত মানুষদের মধ্যে হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন প্রান ত্যাগ করছে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে খবর আসছে মানুষ মারা যাচ্ছেন বিনা চিকিৎসায়।
পরোক্ষ প্রভাবঃ
প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য লকডাউন এর ফলে ছোট-বড়ো-মাঝারি বিভিন্ন ধরনের শিল্প অস্তিত্বসংকটের সম্মুখীন। এগুলির সাথে যুক্ত অসংখ্য মানুষ তাদের জীবিকাও হারিয়েছে। বেড়েছে বেকারত্তের সংখ্যা। বিশ্ব অর্থনীতি পড়েছে সংকটের মুখে। সমাজের বুকে থাবা বসাচ্ছে দারিদ্র, অনাহার, খাদ্যাভাব। মাস্ক বা স্যানিটাইজারের মত প্রতিরোধমূলক উপকরণগুলোতে শুরু হয়েছে দুর্নীতি। বেড়েছে কালোবাজারি ।
উপসংহার ঃ
কথায় বলে, সভ্যতা যখন নিজের গতিকে অপ্রতিরোধ্য বলে মনে করে, সৃষ্টি তখন সমগ্র সভ্যতাকে ক্ষণিকের জন্য থামিয়ে দেয়। একটি ক্ষুদ্র ভাইরাস যেন আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে এই সত্যতাই প্রমাণ করে দিল। আমরা সৃষ্টির কাছে কতখানি অসহায় তা আবারো প্রমান হল । তবে মানুষের এই অসহায়তায় প্রকৃতি বিশ্বজুড়ে দূষণকে কমিয়ে বায়ুকে বিশুদ্ধ করে তুলেছে ধীরে ধীরে। লকডাউনে শুনশান হাইওয়েতে বন্য নীলগাইয়ের চরে বেড়ানো আমাদের মুগ্ধ করেছে। তবে একথা সত্যি যে এই দুর্যোগের মেঘ কাটিয়ে উঠে আমরা আবার সুস্থ পৃথিবীতে শ্বাস নিতে পারব। আমাদের সবসময় মনে রাখতে হবে সৃষ্টির সাথে তাল মিলিয়ে সভ্যতার জীবনযাপনেই জীবনের প্রকৃত সার্থকতা।